কবি
কবি সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক, যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একজন কবি তার রচিত ও সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত উভয়ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যত যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি। তবে বাংলা ভাষার প্রধানতম আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। অর্থাৎ কবিতা লিখলেই বা কবি অভিধা প্রাপ্ত হলেই কেউ “কবি” হয়ে যান না। একজন প্রকৃত কবির লক্ষণ কী তা তিনি তার কবিতার কথা নামীয় প্রবন্থ গ্রন্থে সবিস্তারে তুলে ধরেছেন।
"যিনি শব্দের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য্যমুখর শৈল্পিক প্রয়োগের মাধ্যমে কোন একটি বা একাধিক বিষয়ের অনুপম ভাবধারার শ্রুতিমধুর, সৃজনশীল, ছন্দোবদ্ধ কথামালাকে কল্পনা কিংবা বাস্তবতা অথবা উভয়ের সংমিশ্রণে প্রকাশ করেন এবং তা পাঠকের চিত্তকে আকৃষ্ট ও মোহিত করে; তিনিই কবি।"
প্রেক্ষাপট
সম্পাদনাকবিদের উৎপত্তি রহস্য অজ্ঞাত ও অজানাই রয়ে গেছে। সেই অনাদিকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যুগ-যুগ ধরে তারা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন নিত্য-নতুন কবিতা। কবিতাগুলো একত্রিত করে তারা কবিতাসমগ্র বা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কখনো কখনো কাব্যগ্রন্থটি বিরাট আকার ধারণ করে সৃষ্টি করেন মহাকাব্য। প্রায় সকল ভাষায়ই কবিতা রচিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ভিন্ন সময়কে উপজীব্য করে রচিত হওয়ায় এগুলোর আবেদন, উপযোগিতা এবং ভাবও সাধারণতঃ ঐ সময়ের জন্য উপযোগী। তবে কতকগুলো কবিতা কালকে জয়ী করেছে বা কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে।[১] প্রত্যেক সমাজ-সভ্যতা ও নির্দিষ্ট ভাষায় রচিত হওয়ায় কবিরা বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভঙ্গিমা, সৃষ্টিশৈলী প্রয়োগ করেছেন তাদের কবিতায় যা কালের বিবর্তনে যথেষ্ট পরিবর্তিত, পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। পরবর্তীকালে এই প্রায়োগিক বিষয়াদিই ঠাঁই করে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের পর্দায়। সাহিত্যের ইতিহাসে উৎপাদিত এই বৈচিত্র্যময় শিল্প শৈলীই বর্তমান সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে।
উৎপত্তি রহস্য
সম্পাদনাবাংলা সাহিত্য | |
---|---|
| |
বাংলা সাহিত্য (বিষয়শ্রেণী তালিকা) বাংলা ভাষা | |
সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাঙালি সাহিত্যিকদের তালিকা | |
কালানুক্রমিক তালিকা - বর্ণানুক্রমিক তালিকা | |
বাঙালি সাহিত্যিক | |
লেখক - ঔপন্যাসিক - কবি | |
সাহিত্যধারা | |
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চর্যাপদ - মঙ্গলকাব্য - বৈষ্ণব পদাবলি ও সাহিত্য - নাথসাহিত্য - অনুবাদ সাহিত্য -ইসলামী সাহিত্য - শাক্তপদাবলি - বাউল গান আধুনিক সাহিত্য উপন্যাস - কবিতা - নাটক - ছোটোগল্প - প্রবন্ধ - শিশুসাহিত্য - কল্পবিজ্ঞান | |
প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কার | |
ভাষা শিক্ষায়ন সাহিত্য পুরস্কার | |
সম্পর্কিত প্রবেশদ্বার সাহিত্য প্রবেশদ্বার বঙ্গ প্রবেশদ্বার | |
কবি শব্দটি 'কু' ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। 'কু' অর্থ' অ-সাধারণ (নবরূপে উত্তীর্ণ) কারী। [২] এতেই বোঝা যায় কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। ইংরেজী শব্দ 'পয়েট' (poet), ল্যাটিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ 'পয়েটা, পয়েটে' ('poeta, poetae') (আক্ষরিক অর্থ 'কবি, কবি এর') থেকে সংকলিত হয়েছে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ "কবি" শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন,
“ | একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুঁটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরনের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সাথে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন, যেখানে খুশী অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরনের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন! যদি তিনি অজানা, অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি তিনি বিকৃত, উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন - তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অ-শ্রুত, নামবিহীন অজানা বিষয়াদি ধ্বংস করেনঃ অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায় সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবে যা পূর্বেই নিপতিত হয়েছিল! | ” |
অবশ্য, এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক কবিকূলের মধ্যে একজন কবি যিনি তার দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন মাত্র।[৩]
বুদ্ধদেব বসু তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত: কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আছে "কবি" সম্পর্কে স্বীয় ধ্যান-ধারণার সারকথাঃ
সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একবার কবিদের কাজ সম্বন্ধে বিবৃত করেছিলেন যে,
“ | গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সাথে তুলে ধরা বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ঐদিন পরিশোধিত করবে যা কখনো ভুলে যাবার মতো বিষয় নয় এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। (দ্য প্রিলুড বুক ওয়ান) |
” |
ম্যারিয়েন মুরে কর্তৃক কবিদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন যে,
“ | তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। (পয়েট্রি) | ” |
অন্যান্য অনেক কবি যেমনঃ 'এইনিডে' ভার্জিল এবং 'প্যারাডাইজ লস্টে' জন মিল্টন বর্ণনা করেছেন যে, 'গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কাব্য ও সঙ্গীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকাণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন'।
সংজ্ঞা নির্ধারণ
সম্পাদনাকবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্ম-ভূমি। অর্থাৎ, সময়-বিশেষে কোন একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখনই কবিতার জন্ম। কবি বেদনাকে আস্বাদ্যমান রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত বেদনার বিষপুষ্প থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও সুন্দর হয়ে উঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, তাঁকে এটি দ্রষ্টা না হতে পারলে তার দ্বারা কাব্য-সৃষ্টি সম্ভব নয়। কবির বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ক্রোচে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে -
“ | Poetic idealisation is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation. | ” |
বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা কল্পনাকে যে-লেখক অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনু-শ্রী দান করতে পারেন, তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি।
অনেকে বলেন যে, যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি। অর্থাৎ, কবি জগতের ভালো-মন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করবেন। <ref name = "L">"সাহিত্য-সন্দর্শন", শ্রীশচন্দ্র দাশ, বর্ণ বিচিত্রা, ঢাকা, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৯৫, পৃষ্ঠাঃ৩০-৩১</ref
"যিনি ভাবনা ও কল্পনায় ডুবে থাকতে ভালোবাসেন এবং সৃষ্টিশীল তিনি কবি"। উক্তিটি করেছেন প্রণব কুমার সত্যব্রত
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Orban, Clara Elizabeth (১৯৯৭)। The Culture of Fragments: Word and Images in Futurism and Surrealism। Rodopi। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 90-420-0111-9।
- ↑ কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী রচিত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা-১৮৫, প্রকাশক ভাষাবিন্যাস, কলকাতা। আশ্বিন ১৪১৬।
- ↑ Rimbaud, Arthur (১৯৫৭)। Louise Varèse, সম্পাদক। Illuminations, and Other Prose Poems। New Directions Publishing। পৃষ্ঠা xxx। আইএসবিএন 0-8112-0814-8
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)।