আরবি নামকরণ পদ্ধতি
আরবি ভাষার নাম ঐতিহাসিকভাবে একটি দীর্ঘ নামকরণ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে করা হয়। আরবি- ভাষী এবং মুসলিম দেশগুলির অনেকেই নামের শেষে পূর্ব বংশীয় নামগুলির একটি লম্বা চেইন জুড়ে দেয়। এই পদ্ধতিটি আরব এবং মুসলিম বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত রয়েছে।[১]
নামের গঠনপ্রণালী
সম্পাদনাইসম
সম্পাদনাইসম (اسم ) হল প্রদত্ত নাম। অর্থাৎ জন্মের পর প্রথম যে নাম রাখা হয়। যেমন : আহমদ বা ফাতিমা। বেশিরভাগ আরবি নামের অর্থ সাধারণ বিশেষণ এবং বিশেষ্য হিসাবে থাকে এবং প্রায়শই চরিত্রের উচ্চাকাঙ্খী হয়। উদাহরণস্বরূপ মুহাম্মদ মানে 'প্রশংসনীয়' এবং আলী মানে 'উন্নত' বা 'উচ্চ'।
আফ্রিকা, আরব, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশ জুড়ে মুহাম্মদ নামের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এটি প্রায়শ সংক্ষেপে 'Md'., 'Mohd' এবং বাংলায় 'মো'. লেখা হয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনে মুহাম্মাদ প্রথম নাম হিসাবে প্রায় সর্বব্যাপী ব্যবহারের কারণে একজন ব্যক্তিকে প্রায়শই তাদের দ্বিতীয় নাম দ্বারা উল্লেখ করা হয়। এসব অঞ্চলে প্রতিজন মানুষের নামের শুরুতে মুহাম্মাদ লেখা হয়। যেমন : মো. উসমান, মো. উমায়ের, মো.তানভীর ইত্যাদি।
নসব
সম্পাদনানসব হল বংশ পরস্পরার বর্ণনা। এটি আসল নাম না ইসমের পূর্বে ছেলে হলে ইবনে (ابن) এবং কন্যা হলে বিন্ত (بنت) শব্দ দ্বারা নির্দেশ করা হয়। এর অর্থ হয় "এর ছেলে (Son of) বা এর মেয়ে (Daughter of)। যেমন: ইবনে খালদুন (ابن خلدون ) অর্থ "খালদুনের ছেলে"। এখানে খালদুন তার পিতার ব্যক্তিগত নাম। তবে কখনো একটি দূরবর্তী পূর্বপুরুষের নামও হতে পারে।
লাকাব
সম্পাদনালাকাব এর অর্থ ডাকনাম, পদবি, উপাধি বা পারিবারিক নাম করা যেতে পারে।[২] লাকাব সাধারণত ব্যক্তির বর্ণনামূলক নাম হয়। লাকাব বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন: আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদ। হারুন হল তার প্রথম বা আসল নাম এবং আল রশিদ হল তাঁর লাকাব। লাকাব কখনো যৌগ রূপেও ব্যবহৃত হয়। যেমন: সালাহ আল-দীন, শামস আল-দীন, নূর আল-দীন, নাসির আল- দাওলা, নিজাম আল মুলক, সাইফ আল-ইসলাম। এই শব্দগুলি বাংলায় সালাহুদ্দীন/সালাহ উদ্দীন, শামসুদ্দীন/শামস উদ্দীন, নিজামুল মুলক এভাবে লেখা হয়। প্রাচীন আরব সমাজে লাকাবের ব্যবহার সাধারণ ছিল, কিন্তু বর্তমানে জন্মগত উপাধি বা পারিবারিক নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ।[৩]
নিসবাহ
সম্পাদনাআরবি নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নিসবাহ। নিসবাহ অর্থ কাউকে তার জন্মস্থান বা অন্য কোনো জায়গার প্রতি সম্পৃক্ত করা। এতে নামের সাথে ব্যক্তিটি কোন জায়গায় বাসিন্দা তা সহজে জানা যায়। যেমন: হাসান আল বসরি। হাসান তাঁর জন্ম নাম। তিনি বসরার বাসিন্দা ছিলেন বিধায় সেদিকে সম্পৃক্ত করে তাকে বসরি/আল বসরি বলা হয়।[৩]
কুনিয়াৎ
সম্পাদনাকুনিয়াৎ অর্থ উপনাম করা যেতে পারে। কাউকে তার সন্তানের নামের দিকে সম্পৃক্ত করে যে নামে ডাকা হয় তাই কুনিয়াৎ। যেমন: আবু বকর; এখানে বকর তার ছেলে অর্থাৎ সে বকরের পিতা। এটা ছাড়া ভিন্ন পদ্ধতিতেও কুনিয়াৎ বা উপনাম রাখা যেতে পারে। যেমন: আবু হুরায়রা, আবুল মাল, আবু নাওম প্রভৃতি। নাম লেখার সময় কুনিয়াৎ সবার আগে লিখতে হয়। তবে বর্তমান আরব সমাজে এর তেমন প্রচলন নেই।[৩]
সাধারণ নামকরণের অভ্যাস
সম্পাদনাআরব মুসলিম
সম্পাদনাআরব মুসলমানদের মধ্যে একটি নাম-রূপের একটি হল উপসর্গ আব্দ্ (অর্থ: উপাসক; স্ত্রী: আমাত)। এটিকে আল্লাহ শব্দের প্রতি সম্পৃক্ত করে আব্দুল্লাহ (عبد الله : আল্লাহর উপাসক) নাম রাখা হয়। কখনো এটি আল্লাহর গুণগত নামসমূহের দিকে সম্পৃক্ত করেও নাম রাখা হয়। যেমন: আব্দুল মালেক,আব্দুল খালেক, আব্দুর রহিম ইত্যাদি। তবে আরব সমাজে আব্দুল্লাহ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। নারীদের ক্ষেত্রে আমাতুল্লাহ। [৪] ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা প্রায়শ স্থানীয় অ-আরবী ও অ-ইসলামি নামগুলির ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারেন। তবে সেসব নাম কোনো বহু-ঈশ্বরবাদী অর্থ গ্রহণ না করতে হবে।
আরব খ্রিস্টান
সম্পাদনাকিছু স্পষ্ট ইসলামি নাম ছাড়া (যেমন: মুহাম্মদ) আরব খ্রিস্টানদের এমন কিছু নাম রয়েছে, যা মুসলিমদের থেকে আলাদা করা যায় না কিছু। কিছু সাধারণ খ্রিস্টান নাম হল:
- খ্রিস্টান নামের আরবি সংস্করণ। যেমন: সেন্ট পিটারের জন্য Buṭrus।
- গ্রীক, আর্মেনিয়ান এবং আরামাইক বা নিও-আরামাইক ভাষার নাম।
- ইউরোপীয় নামের ব্যবহার। বিশেষ করে ফরাসি, গ্রীক এবং অল্প পরিমাণে স্প্যানিশ ( মরক্কোতে)। এটি খ্রিস্টান আরবদের মাঝে তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক ঘটেছে, বিশেষ করে লেভান্টে । উদাহরণস্বরূপ: এমাইল এডি, জর্জ হাবাশ, চার্লস হেলো, ক্যামিল চ্যামুন ।
- যীশু খ্রীষ্টের সম্মানে নাম:
- আব্দ্ আল ঈসা (যীশুর দাস), আমাত আল ঈসা (যীশুর দাসী), আব্দ্ আল মাসিহ, আমাত আল মাসিহ।
রাজবংশ বা পারিবারিক নাম
সম্পাদনাকিছু মানুষ বিশেষ করে আরব উপদ্বীপে যখন একজন বিখ্যাত পূর্বপুরুষের বংশধর হয়, তখন তাদের শেষ নাম "آل" দিয়ে শুরু করে। যেমন: ﺁل سعود (আল সা'উদ) অর্থ সৌদের পরিবার বা বংশধর। এমন কয়েকটি নামের উদাহরণ হল : মুহাম্মাদ বিন সালমান আলে সাউদ,আব্দুল আজিজ বিন আব্দুল্লাহ আলে শাইখ প্রভৃতি।
সাধারণ ভুল
সম্পাদনাঅ-আরবি ভাষাভাষীরা প্রায় এই ভুলগুলি করে:
- নামে শব্দের সংমিশ্রণকে আলাদা করা।
- আব্দ্ এর সাথে: আব্দ্ যুক্ত নামগুলো গোটা উচ্চারণ করতে হয়। কারণ কেবল আব্দ কোনো নাম নয়। সুতরাং (উদাহরণস্বরূপ) আবদুর-রহমান বিন ওমর আল-আহমাদকে তার দেওয়া নাম দ্বারা সম্বোধন করার জন্য 'আব্দুর-রহমান' বলতে হবে, কেবল আব্দুর নয়। আবার প্রথম অংশ বাদ দিয়ে কেবল দ্বিতীয় অংশেও ডাকা যায় না। যেমন : আব্দুর রহমানকে কেবল "রহমান" যায় না।
- আরবি সন্ধির সাথে পরিচিত নয় এমন লোকেরা সাধারণত সন্ধিযুক্ত আরবি নাম উচ্চারণ ভুল করে থাকেন। যেমন :হাবীবুল্লাহ (আল্লাহর হাবিব বা প্রিয়) ; এখানে একজন ব্যক্তি ভুল করে লোকটির আসল নাম "হাবিব" এবং "উল্লাহ" উপাধি বলে ধারণা করতে পারেন। কিন্তু হাবিব উল্লাহ উভয় অংশ মিলেই একটি পরিপূর্ণ নাম। পশ্চিমা দেশগুলিতে কিছু অভিবাসী উদ্দিনকে একটি উপাধি হিসাবে গ্রহণ করা শুরু করেছে। যদিও এটি একটি সংযুক্ত নামের দ্বিতীয় অংশ এবং এভাবে নামকরণ আরবিতে ব্যাকরণগতভাবে ভুল। এমনকি ভারতীয় মুসলমানরাও একই ভুল করেন। যদি একজন ব্যক্তির নাম আবদ-উল-রহিম ( আব্দুর রহিম) হয়, অন্যরা তাকে কেবল জনাব আবদুল (দাস) বলে ডাকে, যা আরবি ভাষার একজন স্থানীয় ভাষাভাষীর কাছে বেশ অদ্ভুত শোনাবে।
- নামের মাঝ থেকে কেবল বিন বা ইবন নেওয়া: নামের ক্ষেত্রে বিন বা ইবন শব্দটি পারিবারিক শৃঙ্খলের ক্রম নির্দেশ করে। পশ্চিমারা প্রায়ই আরবদের মধ্যম নাম দিয়ে বিভ্রান্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, সামি বিন আহমেদকে ভুলভাবে মিস্টার বেন বলে সম্বোধন করা হয়। ব্যক্তিটিকে সঠিকভাবে সম্বোধন করতে হলে 'সামি বিন আহমেদ' বা 'সামি' বা 'বিন আহমদ' ব্যবহার করা উচিত।
- ব্যাকরণ: আরবি ব্যাকরণ অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণ থেকে কিছুটা ভিন্ন। যেমন: ইন্দো ইরানি ভাষা থেকে বিপরীত ক্রমে আরবি বিশেষ্য যোগ করা হয়। ২০০২ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় বিবিসির একটি দল কাবুলে একজন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি খুঁজে পেয়েছিল, যার নাম তারা বলেছিল "আল্লাহ মুহাম্মদ"। এটি একটি ভুল বানান। কারণ আরবি ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে এই নামের অর্থ যদি "আল্লাহ যিনি মুহাম্মদের অন্তর্গত" ধরে নেওয়া হয় তাহলে তা ধর্মীয়ভাবে অগ্রহণযোগ্য হবে। যাইোক, ইরানী ভাষা এবং ভারতের অধিকাংশ ভাষার নিয়ম অনুসারে, এই নামের অর্থ "মুহাম্মদ যিনি আল্লাহর অন্তর্গত" যা আরবি "মুহাম্মাদুল্লাহ" এর সমতুল্য।
আরব পরিবারের নামকরণ সম্মেলন
সম্পাদনাবিশ্বের অনেক জায়গার মত আরবি সংস্কৃতিতে একজন ব্যক্তির পূর্বপুরুষ এবং পরিবারের নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি উদাহরণ নীচে ব্যাখ্যা করা হল:
ধরুন, একজন ব্যক্তিকে সালেহ ইবনে তারিক ইবনে খালিদ আল-ফুলান বলা হয় তাহলে:
- সালেহ তার ব্যক্তিগত নাম। তার পরিবার এবং বন্ধুরা তাকে এ নামেই ডাকে।
- ইবনে বা বিন শব্দটি "এর পুত্র"(Sun of) হিসাবে অনূদিত হয়। তাই তারিক হল সালেহের পিতার নাম। সালেহ বিন/ইবনে তারিক মানে তারেকের পুত্র সালেহ।
- ইবনে খালিদ মানে তারিক খালিদের ছেলে অর্থাৎ খালিদ হল তারিকের পিতা এবং সালেহের দাদা।
- আল-ফুলান হবে সালেহের পারিবারিক নাম।
তাই সালেহ ইবনে তারিক ইবনে খালিদ আল-ফুলানের অনুবাদ হয় "সালেহ, (সে)তারিকের ছেলে, (সে) খালিদের ছেলে; (সে) আল-ফুলানে পরিবারের।"
"কন্যা" এর আরবি হল বিনত/বিনতে। ফাতিমা বিনতে তারিক ইবনে খালিদ আল কাজিমি নামের একজন মহিলার নামের অনুবাদ হবে : "ফাতিমা, (সে) তারিকের মেয়ে, (সে) খালিদের ছেলে; (সে) আল কাজিমি পরিবারের।"
এসব ক্ষেত্রে ইবন এবং বিনত সরকারী নামকরণের অন্তর্ভুক্ত। তবে বেশিরভাগ আরব দেশ আজকাল তাদের নামকরণ পদ্ধতিতে 'ইবন' এবং 'বিন্ত' ব্যবহার করে না। সালেহ যদি একজন মিশরীয় হয়, তবে তাকে সালেহ তারিক খালিদ আল-ফুলান এবং ফাতিমা হলে ফাতিমা তারিক খালিদ আল-কাজিমি লেখা হবে।
যদি সালেহ একজন স্ত্রীকে বিয়ে করেন (তিনি নিজের প্রথম ও পারিবাবিক নাম এবং উপাধি বহাল রাখবেন) তাহলে তাদের সন্তানরা সালেহের পারিবারিক নাম গ্রহণ করবে। অতএব, তাদের পুত্র মোহাম্মদকে মোহাম্মদ ইবনে সালেহ ইবনে তারিক আল-ফুলান বলা হবে।
যাহোক, সকল আরব দেশ পূর্ণ দৈর্ঘ্যে নাম ব্যবহার করে না। তবে প্রচলিতভাবে দুই বা তিন শব্দের নাম এবং কখনো কখনো সরকারী বা আইনি বিষয়ে চার শব্দের নাম ব্যবহার করে। এভাবে প্রথম নামটি ব্যক্তিগত নাম, মধ্য নামটি পিতার নাম এবং শেষ নামটি পারিবারিক নাম।
প্রয়োগ
সম্পাদনাধরুন, কারো নাম সালমান,তার পিতার নাম দাউদ এবং তার দাদার নাম আলী। তার উপনাম হল আবুল মাল, তার লাকাব বা উপাধি হল আল বাজ্জার, সে চট্টগ্রামে বসবাস করে তাহলে তার পুরো নাম হবে: আবুল মাল সালমান বিন দাউদ বিন আলী আল-বাজ্জার আল চাটগামী।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Arabic name"। Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-১০-০৯।
- ↑ dnsi.co.za/wp-content/uploads/2012/02/Hans-Wehr-English-Arabic-Dctionary-Searchable-Format-.pdf
- ↑ ক খ গ Encyclopaedia of Islam, Second Edition।
- ↑ Metcalf, Barbara D. (২০০৯-০৯-০৮)। Islam in South Asia in Practice। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 344। আইএসবিএন 978-1-4008-3138-8।